ভারতের মাটিতে দুই টেস্টের পর ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে ব্যাট হাতে জ¦লে উঠতে পুরোপুরি ব্যর্থ বাংলাদেশের টপ-অর্ডারের ব্যাটাররা। যে কারনে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিনের প্রথম সেশনে ৭ উইকেটের হার বরণ করতে হয় বাংলাদেশকে। টেস্ট হারের জন্য টপ-অর্ডার ব্যাটারদের দুষেছেন বাংলাদেশের স্পিন অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ। তিনি জানান, টেস্টে ভালো করতে হলে টপ অর্ডার ব্যাটাদের শুরুটা ভাল করতে হবে এবং তাদের বড় ইনিংস খেলতে হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ছয় ব্যাটারের রান ছিল এমন- মাহমুদুল হাসান জয় ৭০, সাদমান ইসলাম ১, নাজমুল হোসেন শান্ত ৩০, মোমিনুল হক ৪, মুশফিকুর রহিম ৪৪ এবং লিটন দাস ৮।
ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১০৬ রানে গুটিয়ে যাবার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ১১২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ইনিংস হারের শঙ্কায় পড়েছিলো বাংলাদেশ। কারন দ্বিতীয় ইনিংসে ২০২ রানে পিছিয়ে ছিলো টাইগাররা। দ্বিতীয় ইনিংসের সপ্তম উইকেটে মিরাজ ও জাকেরের রেকর্ড ১৩৮ রানের জুটিতে ইনিংস হারের শঙ্কা কাটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে টার্গেট ছুঁড়ে দেয় স্বাগতিকরা। মিরাজ ৯৭ ও জাকের ৫৮ রান করেন। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩০ রান করেন জয়।
ম্যাচ শেষে টপ অর্ডার ব্যাটারদের কাঠগড়ায় তুলেছেন মিরাজ। তিনি বলেন, ‘ব্যাটিংয়ে ডিসিশন মেকিং খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো আমাদের কিছু কিছু জায়গায় ঘাটতি হচ্ছে, এজন্য ব্যাটিংয়ে ভুল করছি আমরা। ওপরের দিকে জুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। টপ অর্ডার থেকে যদি ভালো শুরু করা যায় তাহলে পরের ব্যাটারদের জন্য কাজ সহজ হয়ে যায়।
পাকিস্তানের প্রথম টেস্টে টপ অর্ডারে রান করেছিল। পরে যারা খেলেছে তিন-চারে, তারাও রান করেছে। এতে পরের দিকের ব্যাটারদের কাজ সহজ হয়েছিল। পাঁচ-ছয় নম্বর ব্যাটারকে যদি নতুন বলে খেলতে হয়, তাহলে কাজটা কঠিন। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। যাতে টপ অর্ডার সফল হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দু-একজন ভালো খেললে কখনই দল পারফর্ম করতে পারবে না। পাকিস্তানে যেমন আমরা খুব ভালো পারফর্ম করেছি। কিছু কিছু জায়গায় ঘাটতির পরও জিতেছি। তবে আমাদের উন্নতির জায়গা অনেক আছে। ব্যাটারদের আরও দায়িত্ব নিতে হবে। টেস্ট ক্রিকেটে স্কোরবোর্ডে যদি রান না তুলতে পারি, বোলারদের কাজটা খুবই কঠিন। আমাদের বোলাররা যেভাবে সবসময় চাপে থেকে বল করে এটা অনেক কঠিন। এজন্য বোলারদের কৃতিত্ব প্রাপ্য। ব্যাটিং নিয়েও আলোচনা করছি। প্রতিটি ব্যাটার রান করবে না। যে তিন-চারজন রান করবে তারা যেন বড় ইনিংস খেলতে পারে। আশা করি সামনের দিনগুলোয় বা টেস্টগুলোয় আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।’
মিরাজ আরও বলেন, ‘পাকিস্তানে যে ম্যাচে আমরা ৫’শ রান করেছিলাম, তখন টপ অর্ডারে সাদমান, সৌরভ ভাই (মোমিনুল) ভালো করেছিলেন, মুশফিক ভাই ১৯০ করেছিলেন, লিটনও ফিফটি করেছিল। তাদের সাথে আমার ৭৭ রানে দল ৫শ পার করেছিল।’
প্রথম ইনিংসে ১০৬ রান করায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে লড়াই থেকে ছিটকে পড়ে বাংলাদেশ, এমনটাই মনে করেন মিরাজ। টেস্টে প্রথম ইনিংসের রান মিরাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ব্যাটাররা রান করতে পারিনি। দ্বিতীয় ইনিংসের রান যদি প্রথম ইনিংসেও হতো, তাহলে খেলাটা ভিন্ন হতে পারতো। কিন্তু প্রথম ইনিংসেই ১০৬ রানে অলআউট হয়ে আমরা পেছনে পড়ে যাই। দুই সেশনের আগেই অলআউট হয়েছি। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ইনিংস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ যখন খাদের কিনারায়, তখন ব্যাট হাতে নেমে দুর্দান্ত লড়াই করেছেন মিরাজ। ২১৯ মিনিট ক্রিজে থেকে ১৯১ বলে ১০টি চার ও ১টি ছক্কায় ৯৭ রান করেন মিরাজ। ৩ রানের জন্য টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি না পাবার আক্ষেপ আছে মিরাজের।
তিনি বলেন, ‘একটা ব্যাটার সেঞ্চুরি মিস করলে অবশ্যই খারাপ লাগে। আমারও খারাপ লাগছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা সেঞ্চুরি করার চেয়ে আমি যে পরিকল্পনায় খেলেছিলাম, সেটা বাস্তবায়ন করতে পারলে আরও ভালো লাগতো। সেঞ্চুরি নিয়ে চিন্তা করিনি আমি। চিন্তা করেছিলাম দলকে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারি।’
স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার হয়েও চলমান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫৫৪ রানের মালিক মিরাজ। এই চক্রে ৯ ম্যাচের ১৬ ইনিংসে বেশিরভাগ সময় ছয় বা সাত-এ নেমেছেন তিনি। টেস্ট দলে নিজের ব্যাটিং পজিশন নিয়ে মিরাজ বলেন, ‘আমার কাছে ভালো লাগছে যে, সুযোগ কাজে লাগাতে পারছি। কারণ আমি যেখানে ব্যাট করছি, কাজটা অনেক কঠিন। হয়তো আমি ভালো খেললে দল ভালো জায়গায় যাবে, আমি খারাপ খেললে দল ফলাফল করবে না। মানসিকভাবে চেষ্টা করছি নিজে ভালো খেলতে। খেয়াল করেছি আমি রান করলে দল উপকৃত হয়। এজন্য প্রতিটি দিন চেষ্টা করছি, ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে অনেক সময় নতুন বলে ব্যাটিং করতে হয়। ৮০ ওভারের পর ব্যাট করতে হয়। আবার বোলারদের নিয়েও ব্যাট করতে হয়। আমি ওখানে উন্নতি করার চেষ্টা করেছি, অনুশীলন করেছি, মানসিকভাবে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করেছি যে কিভাবে ব্যাট করবো। শুধু টিকে থাকার জন্যই নয়, কিভাবে রান করতে পারি, বোলারদের ওপর দাপট দেখাতে পারি, এগুলো নিয়ে কাজ করছি। দলের অভিজ্ঞ ব্যাটারদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি সবসময় কঠিন পরিস্থিতিতে উপভোগ করার চেষ্টা করি।’
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট দিয়ে বড় ফরম্যাটকে বিদায় জানাতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। টেস্ট দলেও ছিলেন তিনি। কিন্তু নিরাপত্তার কারনে আসতে পারেননি সাকিব। এই বিষয়ে মিরাজ বলেন, ‘সাকিব ভাইয়ের বিষয়টা তো আমরা সবাই জানি। কি কারণে তিনি আসতে পারেননি বা খেলতে পারেননি। আমার মনে হয় না এটা কারও কাছে অজানা। তিনি একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার। বাংলাদেশের হয়ে অনেক কিছু অর্জন করেছেন সাকিব ভাই। যেহেতু একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমার মনে হয়, সবারই তার পাশে থাকা উচিৎ।’
সাকিবের বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে মিরাজকে। এমন ভাবনার সাথে একমত নন মিরাজ। তিনি বলেন, ‘সবাই সবসময় একটা কথা বলে যে, সাকিব ভাইয়ের জায়গায় আমি আসবো। একটা জিনিস দেখেন, সাকিব ভাই কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে অনেক বড় অর্জন করেছেন। প্রায় ১৭ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। তিনি একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার।
আমারটা যদি দেখেন, ধারাবাহিক রান করা শুরু করেছি মাত্র এক-দুই বছর। সাকিব ভাই শুরু থেকেই রান করেছেন। তাই সাকিব ভাইয়ের জায়গায় সাকিব ভাই, আমি আমার জায়গায়। একজন ক্রিকেটারকে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা না করাই শ্রেয়। আমরা সবাই জানি, সাকিব ভাইয়ের অর্জন কত। আর আমি যেখানে ব্যাটিং করি, ৭-৮ নম্বরে। সাকিব ভাই সবসময় টপ-অর্ডারে ব্যাটিং করেছেন। আমার যখন সময় আসবে, অবশ্যই আমি চেষ্টা করবো দলের প্রয়োজনে ভালো কিছু করতে।’